পর্ব - ২
শ্রীচরণেষু মা,
একাকিত্ব বড়ো অদ্ভুত জিনিস। মানুষ কে বড্ড পাল্টে দেয়। যে বাবার সাথে এক সংসার এ থাকবো না বলে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে চলে এলাম, সেই বাবার জন্যেই বাড়ি ফেরার সময় কি উপহার নেবো তাই ভাবি এ দোকান সে দোকান ঘুরতে ঘুরতে। একটা বয়েসে এসে বোধ হয় মানুষ সত্যিই আপনজনদের ক্ষমা করে দিতে শিখে যায়। বা হয়তো এ সব একমাত্র আমারই বৈশিষ্ট ; রাগ জমিয়ে রাখতে আমি কোনোদিনই পারিনা। বহুকাল আগে এক বন্ধুর মুখে শোনা কিছু মহামূল্যবান কথা মনে থেকে গিয়েছিলো : মা বাবা তো আর পছন্দ করা যায় না , আর পাল্টানোও যায় না, তাই হয়তো একটা সময়ের পর ছোটবেলার সব কথা ভুলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে হয়, বুঝতে শিখতে হয় যে মা-বাবা (আর আমার ক্ষেত্রে দিদিও) ছাড়া আর কেউ আপন হয়না, কোনোদিন ও নয়।
যে একা থাকার, স্বাধীনতার জন্যে আমি চার বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিলাম, সেই একা থাকাই আজ আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে হয় স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতে এত দূর চলে এসেছি যে ফেরার পথ ধোঁয়াশা,অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। বাড়ি কবে ফিরবো জানি, কিন্তু মনে হয় কিভাবে ফিরবো তা ভুলতে বসেছি। আচ্ছা মা, মানুষ যা চায় তা পেয়ে গেলে কি সে আবার সেই না পাওয়ায় ফিরে যেতে মরিয়া হয়ে ওঠে? এটাই কি জীবনের সত্যি? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাই, যত মনোমালিন্যই হোক,অন্তত জানবো আমি তোমাদের নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছি, অন্তত একাকিত্ব টুকু লাঘব হবে আমার।
'To find love outside home is a dangerous exercise' - কথা গুলো আমারই লেখা। শব্দ গুলো অনেক আগেই কলমে এলেও, আজ যেন তাদের নবপলব্ধি হলো। সারা শরীরে ঝনঝন করছে ব্যাথা। কান্না আসছে। বুক জুড়ে, নদীর টলটলে জলে এর মতন আমার সারাটা শরীর জুড়ে উপচে পড়তে চাইছে সেই কান্না, তবু এখনো বাড়ি ফিরিনি তাই মন শক্ত করে হেঁটে চলেছি। অচেনা দোকানে দাঁড়িয়ে কাঁদলে জানি কেউ ফিরেও তাকাবে না ; এই দেশ টাই এমন নির্মম, মা। তবু কান্না বুকে আগলে রেখে বাড়ি ফিরছি। শীতের হাওয়ায় চোখে জল আসে, আর চোখের কোল বেয়ে গাল অবদি পৌঁছাতে পৌঁছাতে জমে যায়; ভাগ্যিস জমে যায়। জমা বরফ তারপর গাল থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে এগিয়ে যাওয়া যায়।
Comments
Post a Comment