পর্ব - ১
শ্রীচরণেষু মা,
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম কিনা বলতে পারিনা তবে মন বড় অস্থির হয়ে পড়েছিল নিদ্রাভঙ্গের সময়। তারপর একেবারে বিছানা ছেড়ে উঠে কিছুক্ষন যাবৎ কালকের লেখা একটা খসড়া নিয়ে বসলাম ব্লগ এ আপলোড করবো বলে ; করতে করতে হঠাৎ দূর থেকে ট্রেন এর আওয়াজ কানে এলো। বড় অদ্ভুত এই স্মৃতিচারণের জগৎ। এক ঝলক এ বহুবছর পূর্বে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেলো : ছোটবেলার কথাগুলো, খড়্গপুরের সব স্মৃতির ঢেউ হয়ে মনে আছাড় দেয়। একটা বয়েস এর পর বোধহয় সবার স্মৃতির কৌটো গুলো এক এক করে জীবনের আলমারির সব তাক ভরিয়ে দেয়। আর বাকি জীবন টা সেই তাক থেকে একটা একটা কৌটো নামিয়ে পরিষ্কার করে আবার সযত্নে তুলে রাখতে রাখতেই অতিবাহিত হয়ে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বড় মনে পড়ছিলো আমাদের ছোটবেলার কথাগুলো, খড়্গপুরের স্মৃতিগুলো : আমাদের খড়্গপুর আর সেরকম নেই জানি। থাকবেই বা কি করে ? যারা সেই ভিটে কে মামাবাড়ি করে তুলেছিল, তারা তো সকলেই এক এক করে চলে গেলো। ছোটরা পরিবার-বন্ধুদের মায়া ত্যাগ করে কর্মসন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিলো আর বড়োরা একেবারে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকগমন করলেন। একটা প্রকান্ড বাড়ি কৌশল্যা মোড়ের মাথায় একা দাঁড়িয়ে অপেক্ষার দীর্ঘশাস ফেলে রোজ, তবু তার সদরের উঠোন অশ্রুসিক্ত করতে কারো আগমন হয় না। তোমার ঠাকুরদা যতটা সময় এই বাড়ি নির্মাণ এর সাধনা করেছিলেন, বোধ করি তার অর্ধ্যেক সময়ের মধ্যে তাঁর উত্তরসূরিরা সব শূন্য করে দিয়ে চলে গেলো। আমার আইওয়া সিটির জানলার বাইরে একটু একটু করে আলো ফুটছে , মনে পড়ছে মামাবাড়ির সেদ্ধ ভাত আর উনুন এর ধোঁয়া-র মিশ্রিত সেই অদ্ভুত একটা ঘরোয়া গন্ধ; মনে পড়ছে আমাদের সেই দোতলার ছাদ যা কত কালের আম, কুল,তেঁতুল শুকোনো দেখেছে, কত প্রজন্ম ধরে আগলে রেখেছে ছোট্ট মেয়েদের কিঙ্কিণী। সদরঘরের লাল মেঝে, আর তোষক-তাকিয়াদের মন দিয়ে দাদুর এসরাজ শোনা। মনে পড়ছে সেই চন্দনা মামিমা-এর ঘুঙ্গুর এর আওয়াজ, মান্টি দাদার কীবোর্ড, বড়মামার তবলা। ভেসে আসছে রান্না ঘর থেকে হরিদা-র লুচি ছোলার-ডালের গন্ধ, ভেসে আসছে ঠাকুরঘর থেকে বড়মণির শ্যামাসংগীত এর মধুর সুর।
সবই হারিয়ে গেলো...
আমাদের সেই সবুজ দেয়ালের মামাবাড়ি হারিয়ে গেলো সময়ের বিপর্যয়ে।হারিয়ে গেলো গরমের দুপুরে তিনটে দস্যি মেয়ের উৎপাত, হারিয়ে গেলো সেই কালীপুজোয় আলোকসজ্জিত সিংহদুয়ার, দুরুদুরু বুকে কত বোমা-বাজি ফাটানো। হারিয়ে গেলো ভাইফোঁটায় নতুন শাড়ীর গন্ধ, ও রাংতা চড়ানো নতুন উপহার খোলার উল্লাস।
বেলা বয়ে ৭টা বাজে। জানলার ফাঁক দিয়ে শীতের রোদ গায়ে এসে পরে। দাদুর রেডিও থেকে এখনো যেন কানে ভেসে আসে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সেই ঝিরঝিরে স্বরে রবীন্দ্রসংগীত; এক পশলা অশ্রুবৃষ্টি আর অনেকখানি নস্টালজিয়ার দমকা হাওয়া বয়ে যায় বক্ষস্থলে।
Comments
Post a Comment