পর্ব ৩
শ্রীচরণেষু মা,
শীত , বসন্ত, গ্রীস্ম পেরিয়ে তোমার পাঠানো জিনিস হাতে পাই কাল সন্ধ্যেবেলায়; সাথে এক খানা কাগজ। ভাবলাম হয়তো চিঠি লিখেছো আমাকে, তারপর দেখলাম যে ওষুধ পাঠিয়েছিলে সেই ডাক্তার এর প্রেস্কিপশন মাত্র। অতঃপর মন খারাপ এই হোক বা তোমার আঙ্গুল যে চাল এর ঠোঙা ছুঁয়েছে, সেই ঠোঙা বহু হাজার মাইল অতিক্রম করে আমার কাছে এসে পৌঁছেছে, এই অনুভূতির কাছে অবদমিত হয়েই হোক, চোখে জল এল। এক-দুই ফোঁটায় তাকে থামানো গেলো না । সহস্র ধারায় বয়ে চললো সে। বিকেল তখন পরে আসছে। বাইরে সূর্য মধ্যগগন থেকে নেমে এসে উঁকি দিচ্ছে আমার পশ্চিম এর জানলা দিয়ে: তার অগাধ কৌতূহল আমার মা এর বিদেশ থেকে পাঠানো দ্রব্যাদির ওপর। সারাদিনের ক্লান্তি বুকে নিয়েও অনেক্ষন, প্রায় ঘন্টা দেড়েক তোমার পাঠানো পাঁচফোড়ন এর প্যাকেট , চালের ঠোঙা, চানাচুর, আমার ফেলে আশা জামা গুলো নাড়াচাড়া করলাম, বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। এ কি মায়া , ঈশ্বর এ জানেন। এ কি যে একটা মানসিক দ্বন্ধ আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। বিদেশের এক ঘরের বাড়িতে, শুধু ভালো পদোন্নতি আর টাকার জন্যে এই প্রতিনিয়ত নির্যাতন। দুঃখ হলে কাউকে জড়িয়ে ধরার নেই, শরীর খারাপ হলে কেও জ্বরের মুখে ঘি-আলুসেদ্ধ মাখা ভাত তুলে দেয়ার নেই, মাতৃভাষায় কথা বলার কেও নেই, অথচ বাড়ি ফিরলেও, সব কেমন অচেনা হয়ে যায় ।
সেবার মনে আছে প্রচন্ড দাঁতের ব্যাথায় তুমি ভাতের থালা নিয়ে এসেছিলে খাইয়ে দেবে বলে, আর আমি অভ্যেস বসত সেই থালাই তোমার হাত থেকে নিয়ে নি। তার পরক্ষনেই ভুল বুঝতে পেরে অনেক কেঁদেছিলাম। সব চেয়ে কষ্টের বিষয় এই যে কোথাও কিচ্ছু বদলায় না। বাড়ির সবাই- তুমি, বাবা, দিদি এক এ রকম রয়েছো, এখানেও সবাই এক এ রকম, পাল্টে গেছি শুধু আমি। নিজের অজান্তেই এতটা পাল্টে গেছি মা, আজ আর কোথাও শান্তি পাই না আমি। কাগজ কলম ঠাসা বিদেশের ঘরের কোনায় বসেও না, বাড়ির খোলা জানলার বাতাসবহুল পরিবেশেও না।
Ph. D. এর প্রথম বর্ষে তুমি ফোন করে বলতে, বিদেশের আকাশ কত স্বচ্ছ দেখা যায়, আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেক্ষন তোমার সেই কথা ভেবে, ক্রমে ঝপসা হয়ে এলো দু চোখ কিছুই আর স্বচ্ছ দেখতে পেলাম না।
Comments
Post a Comment